– রাশেদ, তুমি মাত্র কাশি দিয়ে যে কাজটি করলে তা আমার একদমই পছন্দ না।
– কী করলাম আবার?
– তুমি কাশি দিয়ে কফ গিলে ফেলেছ।
– সরি।
– তিন বছরের রিলেশনে তুমি এখনো আমার সামনে সহজ হতে পারো নি কেন?
– কারণটা আমিও জানিনা নেহা৷ জানলে বলবো।
– কীভাবে বলবে?
– চিঠি লিখে তোমাদের দরজার নিচে দিয়ে রেখে আসবো।
– তিন বছরের রিলেশনে মানুষ কত কিছু করে। সেখানে তুমি কাশির পরে কফটা ফেলতে পারলে না। গপ করে গিলে ফেললে।
– সরি৷
– রাশেদ তোমার কি মনে আছে?
– আছে।
– কী মনে আছে?
– তোমার বিয়ে দশ তারিখ। আর এক মাস পর।
– ঠিক। আমি এখন চলে যাবো আর তুমি এখানে বসে থাকবে। পেছন পেছন আসবে না।
– ঠিক আছে।
– ভালো থেকো।
বিকেল পাঁচটা। রমনার এই পাশটা খালি। রাশেদ যে জায়গায় বসে আছে সেই জায়গাটাকে লেক পার বলা হয়।
রাশেদ একটা সিগারেটে ধরালো। সে দেখলো নেহা হেঁটে যাচ্ছে। পেছনে তার হাঁটু পর্যন্ত ঝুলন্ত চুল। নেহা হেঁটে যাচ্ছে আর সেই চুল ছলাৎ ছলাৎ করে ঝুলছে। রাশেদ চোখ ফিরিয়ে নিল এবং সিগারেট টানতে থাকলো।
– নিজেকে যেহেতু পোড়াবেন তাহলে এতো কম দামি জিনিস দিয়ে কেন পোড়াবেন? দামি সিগারেট খেতে পারেন না?
রাশেদ হতভম্ব হয়ে পাশে তাকাতে দেখলো একটি কুকুর তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর আবার বলে উঠলো, আমার চোখগুলো আপনার প্রাক্তন প্রেমিকার মতো না?
রাশেদ অবাক হয়ে কুকুরটির দিকে তাকিয়ে রইলো। আসলেই কুকুরটির চোখ নেহার মতো কিন্তু এ কিভাবে সম্ভব। তার শরীর ঘামছে। এই শীতের মধ্যে তার গায়ে জ্যাকেট যা লেকে ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
– আপনি কি তাকিয়েই থাকবেন। আপনি তো আপনার প্রাক্তন প্রেমিকার চোখের প্রেমে পরেছিলেন। আমার চোখের প্রেমে পরলে কিন্তু সর্বনাশ।
– আপনি কি আসলেই কথা বলছেন?
– যাক কেউ তো সম্মান দিলো। কেউ তো তুই ছাড়া কথাই বলে না।
– আমি কীভাবে আপনার কথা শুনছি?
– বলতে পারেন আমারো একই প্রশ্ন।
– আপনি আর কারো সাথে কথা বলতে পারেন?
– না।
– এমন সময় একটি মহিলা রাশেদের সামনে এসে দাঁড়ালো। শাড়ি পড়া। তার শাড়ি পড়ার ধরণ একদমই ভালো না। শরীরের বিভিন্ন অংশ দেখা যায়। মহিলা এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলে উঠলো, কিয়ো জান্টু, একা একা। আমি খালি আছি। জায়গা খালি থাকলে নিয়ে চলো। সময় কাটবে। তুমি আদর করবা। আমিও করব৷
এমন সময় কুকুরটি পাশ থেকে বলে উঠলো ফিস ফিস করে, উনি কে?
– নিশিকন্যা।
– রাত হতে তো দেরি আছে। এখনি এসেছে কেন?
মহিলাটি আবার বলে উঠে, অই, একা একা কী কথা কস? তর দেহের খাবার দরকার। যা দিয়ে পেট ভরবো না তয় মন ভরবো।
– কত?
– ঘন্টায় পাঁচশো। দামাদামি নাই৷
রাশেদ মহিলাকে পাঁচশো টাকা দিয়ে বললো,কাজটা ছেড়ে দিন।
রাশেদ হেঁটে বের হয়ে গেলো৷ পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকলো কুকুরটিও।
এক সপ্তাহ পর…
রাশেদ তার মেসে বসে নাস্তা খাচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে সে সবসময় তার সাথে কুকুরটিকে দেখে। তার INSOMNIA হয়েছে। সে রাতে ঘুমাতে পারেনা। দিনে ঘুমালে খুব আজব একটি স্বপ্ন দেখে।
রাশেদ দেখে সে একটি কুকুর হয়ে গেছে৷ সে একটি মানুষের চোখ মুখ খুবলে খাচ্ছে। খাওয়ার পর লোকটি ক্ষতবিক্ষত চেহারায় রক্তমাখা চোখে তাকিয়ে আছে।
এসব ভাবতে ভাবতে সে তার এক বন্ধুকে মেসেজ দিলো— বন্ধু আমি খুব বিপদে পড়েছি৷ আমাকে সাহায্য কর। I need a psychiatrist.
কিছুক্ষণ পর উত্তর এলো— ৪৩৭,উত্তর শাহাজানপুর, ৫ তলা, রফিক জামান।
রাশেদ রফিক জামানের সামনে বসে আছে। রফিক জামান একটি স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে বসে আছেন৷ হাতে সিগারেট আর কফি৷ চুলগুলো আইন্সটাইনের মতো কিন্তু মুখ ভর্তি দাঁড়ি। চোখে বড় ফ্রেমের চশমা।
– তোমার নাম রাশেদ?
– জি।
– সিগারেট খাও?
– জি।
– Now, be free.
– Thank you sir
– Now tell me youe problem. In details, as a story.
রাশেদ তার বর্তমান অবস্থার কথা খুলে বললো। সব শুনে রফিক জামান বললেন, বিস্কুট আছে ট্রেতে৷ Take it.
– স্যার। আমি ঘুম থেকে উঠে এসেছি। স্বপ্নটাও দেখেছি৷ ঘুম থেকে উঠার পর অনেকক্ষণ আমি খেতে পারি না। হাতে রক্ত চর্বির গন্ধ লাগে।
– আচ্ছা। আমি একটা পরীক্ষা নেবো। আমার ছেলেকে ডাক দেই। রশু… রশু।
– জি বাবা।
রাশেদ বুঝতে পারলো এই ছেলে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। নয়ত এতো জলদি ঘরে ঢুকতো না। অর্থাৎ এই ছেলে রাশেদের সব কথা শুনেছে৷ রফিক জামান বললেন, রশু, তুমি এই ভাইয়াকে নেট থেকে চারটি কুকুরের ডাক শোনাও।
রশু শোনালো। রাশেদ বলল, স্যার আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। আমি শুধু ঐ কুকুরের কথাই বুঝি৷ সে সময় কুকুরটি ডাকে না।
– রাশেদ, মানুষ বাদে বেশীর ভাগ প্রাণী টেলিপ্যাথির মাধ্যমে কথা বলে। বেশীর ভাগ প্রাণী দেখা যায় একটি শব্দ করতে পারে৷ যেমন বিড়াল পারে ‘ম্যাও’, কুকুর পারে ‘ঘেউ’।
– জি স্যার৷
– তোমার কথা আমি অস্বীকার করবো না। তুমি কিছুদিন পর আসো। আমি চিন্তা করি। রহস্যময় দুনিয়ার অনেক রহস্য চোখের সামনে কানা-মাছি ভোঁ ভোঁ বলে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু ধরা যায় না। কিন্তু একসময় ধরা পরে।
– স্যার, আপনার কী মনে হয়?
– হতে পারে তোমার সাথে কুকুরটির টেলিপ্যাথির মাধ্যমে যোগাযোগ করে।
– স্যার আমি আসি, তবে আমি আবার আসবো। ইয়ে স্যার, বেয়াদবি মনে করবেন না। একটা সিগারেট নেই?
– তোমার গায়ের গন্ধ বলে দেয় তুমি কমদামি সিগারেট খাও। পুরো প্যাকেটটাই তোমার।
কিছুদিন পর…
রাশেদ একটি শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাশ থেকে কুকুরটি বলল, রাশেদ সাহেব চলেন ঐ দিকটায় যাই।
– না।
– আপনি যার জন্য অপেক্ষা করছেন সে ঐ দিকেই যাবে।
– মানে?
– আপনে ঐ বড় চুলের মেয়েটিকে ফলো করেছেন। তার নাম নেহা। পাশের লোকটি কি তার স্বামী?
রাশেদ কিছুক্ষণ নেহা ও পাশের লোকটিকে দেখলো। নেহার বড় চুলগুলো এখনো ছলাৎ ছলাৎ করছে। রাশেদ ও তার কুকুরটি তাদের ফলো করছে। হঠাৎ রাশেদ বুঝতে পারলো জায়গাটা নিরব। কেউ নেই।
রাশেদ এবং কুকুরটি লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের কান্ড দেখতে থাকলো এবং হঠাৎ দেখলো তারা দুজন দুজনকে ঠোঁটে চুমু দিচ্ছে।
রাশেদ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। কুকুরটি গজড়াতে থাকলো। নেহার স্বামী নেহাকে বললো, তুমি ফুচকার দোকানে যাও, আমি আসছি।
নেহা চলে গেল। রাশেদ একা একা হাঁটতে থাকলো লোকটির পিছে।
কুকুরটি হঠাৎ বলে উঠলো, চলো লোকটিকে খালাস করে দেই।
– No
– আমি এখন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বো নাকি তোমার কেনা ছুরি দিয়ে তুমি তাকে মারবে?
– No. আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন!
– Yes
রাশেদ দেখলো কুকুরটি ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকটির উপর এবং স্বপ্নের মতো খুবলে খুবলে চোখ মুখ চিড়ে ফেললো। রাশেদ তা দেখে ভয় পেয়ে দৌড় দিলো। কোথায় দৌড়ে যাচ্ছে সে জানে না।
তিনদিন পর…
রাশেদ রফিক জামানের বাসায় গেল। একইভাবে সে বসা। হাতে কফি আর সিগারেট। পাশে তার ছেলে বসা।
রফিক জামান বললেন, রাশেদ কেমন আছো?
– ভালো স্যার৷
– মাঝে মাঝে মানুষ নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, You solved your problem.
– জানি না স্যার। কিন্তু সেই কুকুরও আমি দেখি না, তার কথাও শুনি না৷ রাতে ঘুমাতেও পারিনা।
– গুড, কীভাবে?
রাশেদ সেইদিনের সব কথা বললো যা শুনে রফিক জামান বললেন, রাশেদ কুকুরটি তাকে মেরেছে এতে কি তুমি নিজেকে অপরাধী মনে করো?
– জানি না স্যার।
– সেদিন কি তুমি এখনের পরে থাকা জামাটি পরেছিলে?
– জি স্যার। সেদিন আমি মূলত বাসার জন্য একটি ছুড়ি কিনেছিলাম কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি।
– রাশেদ তুমি নিঃসঙ্গ। দয়া করে বিয়ে করো। নেহার সাথে আবার যোগাযোগ করো।
রফিক জামান কথা শুনে মন খারাপ করে বললো, জি স্যার, আসি।
– এসো।
রাশেদ বেরিয়ে গেলো। রফিক জামানের ছেলে ক্লাস টেনে পড়ে৷ সে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, Case টা কি unsolved বাবা?
– না।
– তাহলে তাকে বললে না কেনো?
– শুনবি? তাহলে পড়ার বই খাতা বন্ধ কর।
– বলো।
– Multiple personality disorder নামে একটি মানসিক ব্যাধি আছে, যা নিঃসঙ্গতার কারণে হয়৷
– কী হয় এতে?
– মানুষটি তার কল্পনায় নতুন কাউকে তৈরী করে৷ তাকে দিয়ে তার মতো জীবন চালায়, কাজ করায়, কিন্তু রিয়েলিটিতে সেই সব কাজ করে লোকটি নিজেই।
– তাহলে উনি যে বলবো কুকুরটি মানুষটিকে মেরে ফেলেছে।
– খেয়াল করেছিস, তার শার্টে রক্ত লেগে ছিল যা দেখে বোঝা যায় সেই রক্ত কিছুদিন আগেই লেগেছে এবং সেইদিন তার সাথে একটি ছুরি ছিলো যা সে বাসার জন্য কিনেছে৷
রফিক জামানের ছেলে অবাক হয়ে বলল, মানে! আমরা একটি খুনির….
– হ্যা, সে চাচ্ছিল লোকটিকে মারতে এবং কল্পনায় তৈরী কুকুরটিও তাই চাচ্ছিলো। মেরেছে রাশেদ নিজেই কিন্তু কল্পনায় সে কুকুরটিকে দিয়েই মারিয়েছে।
– তুমি তাকে বললে না কেনো বাবা?
– নিঃসঙ্গ মানুষের ভুল আমার চোখে পড়ে না বাবা। হোক সেটা খুন। আরও একটি কারণ আছে।
– কী?
– MPD এর রোগীরা দ্বিতীয় সত্ত্বা হিসবে গ্রহণ করে নেয় কোনও একজন মানুষকে। কিন্তু রাশেদ গ্রহণ করেছে একটি কুকুর। এটি কি অন্য রোগ? নাকি নতুন রহস্য। আমি তা জানিনা। তাই কোনও সাহায্য করি নি৷