হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে সবকিছু।
হঠাৎ দেখলে মনে হবে, যেন গাছটা নেতিয়ে পড়েছে। গাছটা আসলে গোড়া থেকে একটু বাঁকা। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো অনেকটা। হেলানো গাছটার সাথে একই ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে আছে মতিন।
দু’পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে গাছে পিঠ এলিয়ে দিয়েছে সে। ডানদিকে কয়েক কদম করে জায়গা ছেড়ে দিয়ে সারি সারি গাছ। বামদিকে কিছুটা দূরে পিচের রাস্তা। মাসখানেক আগে তৈরি হয়েছে। এখনো ঝকঝকে। গাছের সারির পিছনদিকে বড় একটা পুকুর। আসলে পুকুরের পারই এটা। মতিন এখানেই বসে আছে। আর তার সামনে বিশাল জায়গাজুড়ে অনেকগুলো চাষের জমি। ধান এখনো পাকেনি। জমিগুলোর মাঝে মাঝে দুয়েকটা টিলার মতো দেখা যায়। মাটির স্তূপ ওগুলো। দুবছর আগে ইটের ভাঁটা ছিল এ এলাকায়। এখন অবশ্য নেই। তাই তো মাটির স্তূপ বাদে বাকি ফাঁকা জায়গায় এখন চাষবাস করা হচ্ছে। এতো কষ্টের মাঝেও একটু শান্তি যেন ফিরিয়ে দিতে পেরেছে এই পরিবেশ।
যদিও এই জমিই তার সর্বনাশ ডেকে এনেছে। হ্যাঁ, জমির জন্যই তো কয়েক বাড়ি পরের জামিল-করিম দুই ভাই মতিনের পিছু লেগেছে। শুধু পিছু লেগেছে নয়, একদম ঘাড়ে উঠেপড়ে লেগেছে বলা যায়।গত কয়েকদিন ধরে হুমকি ধামকি শাসানি যা করার সব করেছে। অবশ্য সব করেছিল তা বলা যায় না। কারণ, সবের যে শেষ ধাপটা রয়েছে সেটা তো আজকেই করার কথা। করেই ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু সফল হয়নি শেষ পর্যন্ত।
বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। কেমন একটা ব্যথা হৃৎপিন্ডের বা পাশ ঘেঁষে। বুকের বাদিকের ফোঁকরটা দিয়ে রক্ত পড়ছে এখনো। অনবরত। হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে মতিন। তারপরও রক্ত গড়িয়ে পড়ছেই। আকাশের গোলগাল চাঁদের আলোয় রক্তের রঙ কালচে দেখাচ্ছে এখন। চাঁদটা কী বড় দেখাচ্ছে! যেন একদম সামনেই। যেন আরেকটু এগোলেই ছোঁয়া যাবে। অবশ্য যেতে হলে উড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
যন্ত্রণাটা বেড়েই চলেছে। মাথাও কেমন ঝিমঝিম করছে। শরীর অসাড় হয়ে আসছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফল। নড়ার শক্তি লোপ পেয়েছে মতিনের। সে বুঝলো আর উঠে লাভ নেই। এর থেকে আরাম করে বসে থাকাই ভালো। বসে বসে ভাবতে লাগলো মতিন, মানুষ এমন কেন?
আজকে শুক্রবার। সন্ধ্যার দিকে বাজারে গিয়েছিল। ছেলেটা বলছিল, আব্বা, মুরগির মাংস খাব, মুরগি ভুনা। ছেলেটা এমনিতে কিছু খেতে চায় না। আজ যখন চেয়েছে, তখন না এনে কি আর পারে। খুশি মনে সদাই নিয়ে বাড়ি ফিরছিল মতিন। গাছপালায় ঘেরা মোটামুটি অন্ধকার একটা জায়গায় এসে পড়েছে, হুট করে দুজন লোক সামনে এসে দাঁড়ালো, গাছের আড়াল থেকে। তাদের পিছে আরো দুজন। সামনের দুজনকে না চিনলেও পিছনের জনদের ভালোভাবেই চিনেছে মতিন। দুই ইবলিশ, জামিল-করিম। এর পরপরই সামনের দুজন হামলে পড়লো মতিনের ওপর। মতিনও বাজার ফেলে সমানে লড়তে লাগলো। ধুপধাপ কিল ঘুসি বসিয়ে দিতে থাকলো ওদের ঘাড়ে। এমন সময় চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠল কি যেন, চোখের পলকে বসে গেল মতিনের বুকে। বের হয়ে গেল সেটা। ছুড়ি। আবার এগিয়ে আসতে লাগলো। মতিন আর সুযোগ দিল না। জোরে এক ধাক্কা মেরে সরে এলো সে। সেখান থেকে ছুট লাগালো উল্টো দিকে। এক দৌড়ে এসে পড়ল এই পুকুর পাড়ে।
মতিন এবার ভাবতে শুরু করল তার পরিবার নিয়ে, বউ-বাচ্চা নিয়ে। আসলে পরিবার বলতে শুধু ওই বউ আর বাচ্চাটাই আছে মতিনের। ছেলেটার কী হবে ভেবে কোনোই কূল কিনারা পায় না সে। অতটুকু একটা বাচ্চা, বয়স মাত্র ছয় হলো। আর বউটাও তো মরামুখি। কী এক রোগ হলো, সেই যে বিছানায় পড়েছে বেচারি, আর উঠবার জোর নেই। শুকিয়ে একদম লিকলিকে হয়ে গেছে। কিছু খেতেও পারে না। রুচি নেই নাকি। এসব ভেবে কষ্টে বুকের ব্যথা আরো বেড়ে যায় মতিনের। এবার নাকমুখ দিয়েও রক্ত গড়াতে থাকে। শরীরটাকে কত ভারী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন পাথর হয়ে যাচ্ছে হাত পাগুলো। শক্ত হতে হতে এগিয়ে আসছে উপর দিকে।
প্রচন্ড হাওয়া। ভেসে যাচ্ছে সবকিছু। গাছগুলো হেলছে দুলছে। ধানের শিসের ওপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ নিজেকে অনেক হালকা মনে হলো মতিনের। একদম ফুরফুরে। সে তাহলে সুস্থ হয়ে গেছে? ভাবলো মতিন। উঠে দাঁড়ালো। কোনো কষ্ট হলো না। আসলেই সে ঠিক হয়ে গেছে। এখন সে পুরোপুরি সবল। নিজেকে এতটাই ফুরফুরে মনে হচ্ছে যেন হাওয়ার ধাক্কায় উড়েই যাবে। সে ভাবলো, যদি সত্যিই সে উড়তে পারত!
অমনটা ভাবতেই হঠাৎ তেড়ে আসা দমকা হাওয়ার সাথে সত্যি সত্যি উপরে উঠে গেল মতিন। উঠে নয়, উড়েই গেল বলা যায়। মতিনের আনন্দ দেখে কে। জমিগুলোর উপরে হাওয়ায় ঘুরপাক খেতে লাগল সে। হাত দিয়ে সাঁতার কাটার মতো ভঙ্গি করলো, সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেল আরো উপরে। আবারো ঘুরপাক খেতে শুরু করল। পিছনে সেই পুকুর পাড়ে ফিরে দেখল মতিন। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে কে যেন দেখছে ওকে। তাহলে কি জামিল-করিমের দলের কেউ? এখানে অব্দি পৌঁছে গেছে। আসুক, কোনো লাভ নেই। মতিনকে ধরার সাধ্য এখন আর ওদের নেই।
মতিন সামনে তাকালো। ওইযে বিশাল গোল চাঁদটা। এইতো সামনেই। আরো একটু এগোলেই ধরা যাবে। মতিন হাওয়ায় ভেসে ভেসে আরো উপরে উঠলো। আরো উপরে। আরো।